ঢাকা , রবিবার, ২৫ মে ২০২৫ , ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

​পদ ফাঁকা, তবু নেই পদোন্নতি!

স্টাফ রিপোর্টার
আপলোড সময় : ২৫-০৫-২০২৫ ০৩:৪৬:৪৭ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৫-০৫-২০২৫ ০৭:৫৮:৪৭ অপরাহ্ন
​পদ ফাঁকা, তবু নেই পদোন্নতি! গ্রাফিক্স : বাংলা স্কুপ
আমিনুল কবীর সুমন॥
পদ ফাঁকা রয়েছে, কিন্তু তারপরও দীর্ঘদিন ধরে পদোন্নতি হচ্ছে না ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) প্রকৌশল বিভাগে। জনবল সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং জরুরি সেবাগুলো সময়মতো দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি বেশিরভাগ কর্মকর্তাকে তাঁদের দায়িত্বের অতিরিক্ত কাজ করতে হচ্ছে পারিশ্রমিক ছাড়াই। বাড়তি পরিশ্রম যেমন এসব কর্মকর্তার শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব ফেলছে, তেমনি এক ধরনের মানসিক চাপ ও হতাশার মুখোমুখি হচ্ছেন তাঁরা। অনেক প্রকৌশলী পদোন্নতি না পেয়ে উন্নত চাকরির জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেককে মনে কষ্ট নিয়ে অবসরে চলে যেতে হচ্ছে। এতে সেবামূলক এই খাতটিতে বিরুপ প্রভাব পড়ছে। গ্রাহকসেবায় বাড়ছে দুর্ভোগ।

প্রকৌশলীরা বলছেন, এতোদিন পদোন্নতি আটকে রাখা হয়েছিল আদালতের দোহাই দিয়ে। হাইকোর্টের মত আপিল বিভাগও জ্যেষ্ঠতা অনুসারে পদোন্নতির পক্ষে অবস্থান নিলেও সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। পছন্দের মানুষকে পদোন্নতি দেয়ার লক্ষ্যে বিগত স্বৈরাচার সরকার যে আইন করেছিল, স্বৈরাচারের দোসররা সেটাই বলবৎ রাখার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, ডিপিডিসিতে ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের দোসররা আপিল বিভাগের রায়ের বিপরীতে রিভিউয়ের চিন্তা করছে যা মূলত চলমান সংকটকে আরো দীর্ঘায়িত করবে। এতে প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশে বিদ্যমান বৈষম্যের নিরসন তো হবেই না, উল্টো বিদ্যুতের মত জরুরি সেবা খাতকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেবে। 

সংস্থাটির এইচআর সূত্র থেকে জানা যায়, ডিপিডিসির বর্তমান সেটআপ অনুযায়ী প্রধান প্রকৌশলী থাকার কথা আটজন, কিন্তু কর্মরত রয়েছেন ছয়জন, পদ ফাঁকা রয়েছে দুইজনের। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ৩৫জন থাকার কথা, রয়েছেন ৩৪ জন। নির্বাহী প্রকৌশলীর অনুমোদিত পদ ৮৬, কর্মরত জনবল ৪৭, শূন্য পদ ৩৯। উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলীর ৯৫ পদের বিপরীতে ৭৩ জন কর্মরত রয়েছে, পদ ফাঁকা রয়েছে ২২টি। সহকারী প্রকৌশলীর অনুমোদিত পদ ১৩৪, কর্মরত জনবল ১২৯, শূন্য পদ ৫। 

ডিপিডিসি সূত্র জানাচ্ছে, শূন্য পদগুলোতে পদোন্নতি বা লোকবল নিয়োগ না দেওয়ায় বছরের পর বছর জোড়াতালি দিয়ে কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এই চিত্র প্রকৌশলী বিভাগের হলেও একই রকম সংকটে ভুগছে অন্য বিভাগগুলোও । কারিগরীর বিভিন্ন পদে নিয়োগ না হওয়ায় বেশির ভাগ জায়গায় বাৎসরিক ঠিকাদার দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। এতে করে প্রতি মাসেই ডিভিশনগুলোতে বিদ্যুৎচুরি ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে, পাশাপাশি ব্যাহত হচ্ছে গ্রাহকসেবা। সামগ্রিক প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও।

প্রকৌশলীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ডিপিডিসির বিদ্যমান সেটআপে এমনিতেই লোকবলের চরম সংকট রয়েছে। তার উপর প্রতিষ্ঠানটির চারটি বড় প্রকল্প জিটুজি, পিডিএসডি,  এএমআই ও স্মার্ট গ্রিডে বর্তমান সেটআপ থেকেই প্রকৌশলী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সূত্র জানায়, জিটুজি প্রকল্পে পদায়ন করা হয়েছে প্রধান প্রকৌশলী একজন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী চারজন, নির্বাহী প্রকৌশলী ছয়জন এবং উপবিভাগীয় প্রকৌশলী  ছয়জন। পিডিএসডি প্রকল্পে একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, একজন নির্বাহী প্রকৌশলী ও দুইজন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী পদায়িত হয়েছেন। স্মার্ট গ্রিড প্রকল্পে পদায়িত হয়েছেন একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশল, একজন নির্বাহী প্রকৌশলী ও একজন উপবিভাগীয় প্রকৌশলী। আর এএমআই প্রকল্পে পদায়ন করা হয়েছে একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী, দুইজন নির্বাহী প্রকৌশলী ও দুইজন উপবিভাগীয় প্রকৌশলীকে। 

প্রকৌশলীরা বলেন, এই বাড়তি পদায়ন যেন জনবল সংকটে ভুগতে থাকা প্রকৌশলী বিভাগের জন্য মড়ার উপর খাড়ার ঘাঁ। প্রতিটি কর্মদিবসে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত খেটেও আমরা কাজ শেষ করতে পারছি না।

ডিপিডিসির একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা বছরের পর বছর ধরে পদোন্নতির অপেক্ষায় আছি। প্রতিষ্ঠানের কর্মপরিবেশে বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনে এবং সংস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চলতি বছরের ২ জানুয়ারি আমরা ডিপিডিসি’র সকল পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদোন্নতি প্রদানের জন্য গণস্বাক্ষর করে ডিপিডিসির বোর্ড চেয়ারম্যান বরাবর আবেদন করি। কিন্তু অদ্যাবদি তার কোন ফলপ্রসূ আউটপুট প্রতিষ্ঠানে দেখতে পাচ্ছি না। অথচ কাজের চাপে আমাদের শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়তে হচ্ছে। এটি দীর্ঘমেয়াদে এই সেবা খাতকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানে কর্মরত একাধিক প্রকৌশলী জানান, প্রশাসন এতোদিন বলে আসছিলো মামলার কারণে পদোন্নতি আটকে আছে, কিন্তু সিনিয়রিটির ভিত্তিতে পদোন্নতির হাইকোর্টের রায়ের বিপক্ষে ডিপিডিসি কর্তৃপক্ষ আপিল করলেও পূর্বের রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। তাই প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলে সকল পদে এখনই সিনিয়রিটির ভিত্তিতে পদোন্নতি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের শৃংখলা ফিরিয়ে আনতে পারে। কিন্তু প্রশাসনের কতিপয় ব্যক্তির কার্যকলাপ প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আরো হতাশা বৃদ্ধি করছে। প্রশাসনের ওই ব্যক্তিরা বিতর্কিত ভাইবা পদ্ধতি বহাল রাখার মাধ্যমে পদোন্নতি বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ আবারও রাখতে চাচ্ছে।

তাঁরা আরো বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হলেও তাদের দোসররা এখনও রয়ে গেছেন প্রতিষ্ঠানটিতে। প্রতিষ্ঠানটির প্রশাসন বিভাগের সোনামণি চাকমা, মো. হাসনাত চৌধুরী, মো. মনিরুজ্জামান এবং নিহাররঞ্জন সরকাররা এখনো থেমে নেই। এরা আবারও চক্রান্ত করছেন উচ্চআদালত রায়কে পাশ কাটিয়ে ভাইবা পদ্ধতির মাধ্যমে পদোন্নতি দেওয়ার। প্রকৌশলীরা বলছেন, ওই কর্মকর্তারা নতুন করে জটিলতা সৃষ্টির জন্য আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ করারও পায়তারা করছেন। এতে করে সময় ও ডিপিডিসির অর্থ নষ্ট হবে বলে মনে করেন তাঁরা। প্রকৌশলীদের দাবি, জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ঘটনায় হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগ একই রায় দিলে এর বিরুদ্ধে রিভিউ করা বাধ্যতামূলক নয়। কর্তৃপক্ষ চাইলে রিভিউ না-ও করতে পারে।

সংস্থাটির প্রকৌশলীরা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, বিদ্যুৎ উপদেষ্টা, সচিব, বোর্ড চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক-এই চারজনই দক্ষ আমলা। আমাদের দাবি ন্যায্য কি ন্যায্য নয়- তা তাঁরাই ভালো বুঝবেন। আমরা বিশ্বাস করি, বিগত স্বৈরাচার সরকার দীর্ঘদিন পদোন্নতিবঞ্চিত রেখে আমাদের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার তা থেকে আমাদের দ্রুত উত্তরণের পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দ্রুত পদোন্নতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু না হলে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। সমস্যাকে আরো বাড়তে না দিয়ে কর্মী-স্বীকৃতি, সুসংগঠিত মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা এবং প্রণোদনার ব্যবস্থা করা উচিৎ।

বিদ্যুৎ সচিব ফারজানা মমতাজ বাংলা স্কুপকে বলেন, পদোন্নতির বিষয়টি একটি চলমান প্রক্রিয়া। সময়মত পদোন্নতি হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। ডিপিডিসির সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি দেখবেন।

বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) ও ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) নূর আহমদ রোববার (২৫ মে) বাংলা স্কুপকে বলেন, আমি এখানে নতুন দায়িত্ব নিয়েছি। বিষয়টি ওয়াকিবহাল ছিলাম না। উচ্চআদালতের আদেশ শুনেছি। রায়ের সার্টিফাইড কপি পেলে আইন শাখার সঙ্গে কথা বলব। সেই সঙ্গে পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব। তিনি আরো বলেন, আমি পদোন্নতির পক্ষে। যে কোনো প্রকৌশলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সময়মত পদোন্নতি দিলে তাঁদের কাজের দক্ষতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা বৃদ্ধি পায়। আর তখনই তাঁদের কাছ থেকে শতভাগ পেশিদারিত্ব পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়। 

বাংলা স্কুপ/প্রতিবেদক/এইচএইচ/এনআইএন/এসকে

অন্তর্বর্তী সরকারকে ধন্যবাদ জানালেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা
আদালতের রায় মানছে না ডিপিডিসি!
​মেধা ও যোগ্যতা নিশ্চিতে বিশেষজ্ঞ কমিটি


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স


এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ